বীজতলা তৈরিঃ
বীজতলা তৈরির আগে তালিকা ২ দেখে জেনে নিতে হবে কখন কোন জাতের ধানের বীজ বীজতলায় বপন করতে হবে। চারটি পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা যায়। এগুলো হচ্ছে শুকনো, কাদাময়, ভাসমান ও ডাপোগ বীজতলা।
শুকনো বীজতলাঃ
উপযুক্ত আর্দ্রতায় ৫-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটিকে একেবারে ঝুরঝুরে করার পর জমি সমান করে শুকনো বীজতলা তৈরি করা যায়। এবার চারাগাছের পরবর্তী পরিচর্যা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য ২৫-৩০ সেন্টিমিটার চওড়া নালা তৈরি হবে। বেডের উপরি ভাগের মাটি ভালোভাবে সমান করার পর শুকনো বীজ সমানভাবে ছিটিয়ে দিন। এরপর উপরের মাটি এমনভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যেন বীজগুলো ২.৫-৪.০ সেন্টিমিটার (১.০-১.৫ ইঞ্চি) মাটির নিচে চলে যায়। এ কাজকে সহজ করতে ধুলা মাটির আস-রণ দেওয়া যায়। বেডের মাটিতে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা নিশ্চিত করার জন্য নালা ভর্তি করে সেচ দেয়া উচিত।
কাদাময় বীজতলাঃ
দোঁআশ ও এটেল মাটি এ বীজতলায় জন্য ভাল। আরেকটি কথা, বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। যদি জমি হয় তাহলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে দুই কেজি হারে জৈব সার (পচা গোবর বা আবর্জনা) সুন্দরভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর জমিতে ৫-৬ সেন্টিমিটার পানি দিয়ে দু-তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন রেখে দিন এবং পানি ভালভাবে আটকে রাখুন। আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে গেল আবার চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। বেডের দুই পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করা যায়।এরপর বেডের উপরের মাটি বাঁশ বা কাঠের চ্যাপ্টা লাঠি দিয়ে সমান করতে হবে। কাদা বেশি হলে বীজ মাটিতে ডুবে যাবে এবং তাতে ভালভাবে বীজ গজাবে না। এ অবস্থায় বেড তৈরির পৌনে এক ঘন্টা পর বীজ বোনা দরকার। উল্লেখ্য যে, বীজতলা তৈরির জন্য দুই বেডের মাঝে যে নালা তৈরি হলো তা খুবই প্রয়োজন। এ নালা যেমন সেচের কাজে লাগবে তেমনি প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন ও বীজতলার পরিচর্যা করা সহজ হয়।
ভাসমান বীজতলাঃ
বন্যাকবলিত এলাকায় যদি বীজতলা করার মত জায়গা না থাকে এবং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চারা তৈরীর প্রয়োজনীয় সময় না থাকে তবে বন্যার পানি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশ এবং বাঁশের চাটাই-এর মাচা অথবা কলাগাছের ভেলা তৈরী করে তার উপর ২-৩ সে.মি. পরিমাণ পুকুরের তলার মাটির পাতলা কাদার প্রলেপ দিয়ে ভেজা বীজতলার মত বীজতলা তৈরী করা যায়। বন্যার পানিতে যেন ভেসে না যায় তার জন্যে এ বীজতলাকে দড়ির সাহায্যে খুটির সাথে বেঁধে রাখা দরকার। এরপর মাটির আস্তরণের উপর অংকুরিত বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। ভাসমান বীজতলার ক্ষেত্রে অন্য স¦াভাবিক বীজতলার মতই বীজহার (প্রতি বর্গমিটারে ৮০-১০০ গ্রাম) হবে। এক্ষেত্রে একবিঘা জমি রোপনের জন্য ৩৫ বর্গমিটার ভাসমান বীজতলা ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রায় ২৫-৩০ দিনের চারা উঠিয়ে মাঠে রোপন করা যেতে পারে। এভাবে তৈরী চারা অন্যসব স¦াভাবিক চারার মতই রোপন করতে হবে এবং সমস্ত কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা অন্য স¦াভাবিক বীজতলার চারার মতই হবে। গবেষণায় দেখা গেছে এভাবে উৎপাদিত চারা অন্যসব চারার মতই ফলন দেয়। পানিতে ভাসমান থাকার জন্য এ বীজতলায় সাধারণত সেচের দরকার হয় না, তবে প্রয়োজনে ছিটিয়ে পানি দেওয়া যেতে পারে। ব্স্তিারিত জানতেঃ এখানে ক্লিক করুন।
ডাপোগ বীজতলাঃ
বাড়ির উঠান বা যে কোন শুকনো জায়গায় অথবা কাদাময় সমতল জমিতে পলিথিন, কাঠ অথবা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরী চৌকোনা ঘরের মত করে তার মধ্যে অংকুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থেকে চারাগাছ কোনরূপ খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে বীজতলায় প্রয়োজনমাফিক পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। মাত্র দু’সপ্তাহ পরেই এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা রোপন করা দরকার, অন্যথায় চারাগাছ খাদ্যের অভাবে মরে যাবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি অংকুরিত বীজ দিতে হয়। এভাবে প্রস্তুতকৃত ২-৩ বর্গমিটার ডাপোগ বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা এক বিঘা জমি রোপন করার জন্য যথেষ্ট। ডাপোগ বীজতলার প্রস্থ প্রায় ১.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ প্রয়োজন মতো নিতে হবে। এভাবে করা বীজতলা থেকে ১৪/১৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপন করতে হবে। চারার বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারার গুনগতমান নষ্ট হতে থাকে। চারার বয়স কম থাকে বলে অনেক সময় চারার মৃত্যুহার কিছুটা বেশী থাকে। সেজন্য চারা রোপনের সময় প্রতি গোছায় ৪-৫ টি চারা দিলে এসমস্যা কাটিয়ে উঠা যায়। ডাপোগের চারার উচ্চতা কম থাকে বলে জমিতে লাগানোর সময় যেন এমন পরিমাণ পানি না থাকে যাতে করে চারা পানির নীচে চলে না যায় । এক্ষেত্রে রোপিত চারার সকল কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা অন্যসব চারার মতই। গবেষণায় দেখা গেছে ডাপোগ পদ্ধতিতে লাগানো চারা পরবর্তীতে অন্যান্য স¦াভাবিক চারার মতই ফলন দেয়।
বীজ জাগ দেওয়াঃ
উপরে বর্ণিত বীজ বাছাই পদ্ধতিতে বাছাইকৃত বীজ কাপড় বা চটের ব্যাগে ভরে ঢিলা করে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখুন ২৪ ঘন্টা। এরপর বীজের পোটলা পানি থেকে তুলে ইট বা কাঠের উপর ঘন্টাখানেক রেখে দিন পানি ঝড়ে যাওয়ার জন্য। এবার বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২/৩ পরত শুকনো খড় বিছিয়ে তার উপর বীজের পোটলা রাখুন এবং আবারও ৩/৪ পরত শুকনো খড় দিয়ে ভালভাবে চেপে তার উপর ইট বা কাঠ অথবা যেকোন ভারি জিনিস দিয়ে চাপা দিন। এভাবে জাগ দিলে ৪৮ ঘন্টা বা ২ দিনেই ভাল বীজের অঙ্কুর বের এবং কাদাময় বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।
বীজতলায় বপনঃ
সতেজ ও সবল চারা আমাদের প্রধান কাম্য। তাই বাছাইকৃত বীজ ওজন করে নিতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বোনা দরকার। এরূপ ১ বর্গমিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২৫-৩০বর্গমিটার জমি রোপণ করা যাবে। উল্লেখ্য যে, ডাপোগ বীজতলার জন্য প্রতি বর্গমিটারে ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বুনতে হবে এবং শুকনো বীজতলার জন্য বীজ জাগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভেজা বীজতলায় বীজ বেডের উপর থাকে বলে পাখিদের নজরে পড়ে। তাই বপনের সময় থেকে ৪/৫ দিন পর্যন- পাহারা দিতে হবে। তালিকা ২ এ জাত ভিত্তিক বীজ বপনের সময় উল্লেখ করা হয়েছে।
বীজতলার পরিচর্যাঃ
বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখা দরকার। বীজ গজানোর ৫-৬ দিন পর বেডের উপর ২-৩ সেন্টিমিটার পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বোরো মৌসুমে শীতের জন্য চারার বাড়-বাড়তি ব্যহত হয়। এ কারণে রাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখলে ঠান্ডাজনিত ক্ষতি থেকে চারা রক্ষা পায় এবং চারার বাড় বাড়তি বৃদ্ধি পায়। বীজতলায় আগাছা, পোকামাকড় ও রোগবালাই দেখা দিলে তা দমন করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বীজতলায় চারাগাছ হলদে হয়ে গেলে প্রতি বর্গমিটারে ৭ গ্রাম করে ইউরিয়া সার উপরি-প্রযোগ করলেই চলে। ইউরিয়া প্রয়োগের পর চারা সবুজ না হলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তখন প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম করে জিপসাম সার উপরি-প্রয়োগ করা দরকার। ইউরিয়া সারের উপরি-প্রয়োগের পর বীজতলার পানি নিষ্কাশন করা উচিত নয়
চারা উঠানোঃ
চারা উঠানোর আগে বীজতলায় বেশি করে পানি দিতে হবে যাতে বেডের মাটি ভিজে একেবারে নরম হয়ে যায়। চারা উঠাতে এমন সাবধানতা নিতে হবে যেন চারা গাছের কান্ড মুচড়ে বা ভেঙ্গে না যায়। উঠানো চারার মাটি কাঠ বা হাতে আছাড় না দিয়ে আসে- আসে- পানিতে নাড়াচাড়া দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, চারাগাছের শিকড় ছিঁড়ে গেলেও রোপণের পর চারার বাড়-বাড়তির কোনররূপ অসুবিধা হয় না কিন’ কান্ড মুচড়ে গেলে চারাগাছের বেশ ক্ষতি হয়। এ জন্য চারা উঠানোর পর ঐ চারার পাতা দিয়ে বান্ডিল বাঁধাও উচিত নয়। শুকনো খড় ভিজিয়ে নিয়ে বান্ডিল বাঁধতে হবে
তথ্যসূত্রঃ http://dae.shyamnagar.satkhira.gov.bd এবং http://agrinewsbd.com
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
Leave A Comment